চোখজুড়ানো রূপসী এক বুনো ফুল

prothomalo-bangla_2021-09_9c8453a9-597f-48bd-a598-67328172d4cb_C_1-1.jpg

অন্যচোখে রিপোর্ট: গভীর ঘুমে হারিয়ে যেতে যেতে মাঝেমধ্যে এমন কিছু বাড়ি, পথ, দৃশ্য বা স্থানের দেখা পাই, যেগুলো খুবই চেনা মনে হয়। জেগে ওঠার পর এসব দৃশ্য সারা দিন মন নিয়ে খেলা করে, অদ্ভুত এক মায়াবী আবেশ ছড়িয়ে রাখে। বান্দরবান থেকে রাঙামাটি যাওয়ার এই সুদৃশ্য পাহাড়ি পথটুকু অনেকটা ঘুমের ভেতর আবছা আলোয় দেখা তেমনই একটি স্বপ্নখচিত শৈলরেখা। মনে হচ্ছিল এমন একটি পথ ঘুমের ঘোরে কতবার যে পাড়ি দিয়েছি! দুপাশের প্রতিটি ফুল-পাতার সঙ্গে কথা বলে বলে দিনমান কাটিয়ে দিতে চেয়েছি। কিন্তু বাস্তবে কি আর তা সম্ভব? গাড়িচালক যেন সর্বশক্তি দিয়ে গাড়িটি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন গন্তব্যের দিকে! তবু যতটা সম্ভব দুপাশের দৃশ্যগুলোয় চোখ রাখছি।

যানজট, কোলাহল, ধোঁয়া ও ধুলা কিছুই নেই। গাছের পাতাগুলো লোভনীয় সবুজে মোড়ানো। চোখজুড়ানো এর রং। কান পাতলে শুধুই বাতাসের শব্দ শোনা যায়। ঘোরের মধ্যে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সময়। গাড়ি এসে দাঁড়াল কর্ণফুলী নদীর ঘাটে। সামনেই কাগজকলের জন্য বিখ্যাত চন্দ্রঘোনা বাজার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুপুরের খাওয়া সেখানেই সেরে নিলাম। খাবারের বর্ণনা এখানে নাই–বা দিলাম। তবে ‘বাংলা কদু’র কথা স্মরণে থাকবে অনেক দিন! খাওয়ার পর আবার ছুটল গাড়ি। এবারের আকর্ষণ কাপ্তাই লেক। হঠাৎ পথপাশের একমুঠো রং থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করল। মুহূর্তেই মনে হলো কিছুটা ভিন্ন এই রং। গাড়ি থামিয়ে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কিছুটা পেছনে এসে সেই রঙের উৎস খুঁজে পাওয়া গেল। চিনতে অসুবিধা হলো না। এ যে বন-নীল! তবে নাম নীল হলেও ফুলে নীলের ছিটেফোঁটাও নেই। বরং আছে বেগুনি আভা। সম্ভবত নীলগাছের পাতার সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য থাকায় এমন নামকরণ। গাছটি আগে আরও কয়েকবার দেখলেও ফুলসহ প্রথম দেখলাম।

বন-নীল (Tephrosia purpurea) একধরনের বহুবর্ষজীবী বুনো উদ্ভিদ। এটি শাখা-প্রশাখাযুক্ত ছোট ধরনের ঝোপালো গাছ। পাতা ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা, ছোট ও শিরাযুক্ত পত্রক সর্বোচ্চ ২১টি হতে পারে। প্রস্ফুটনকাল শরৎ থেকে শীতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। ফুলের রং গাঢ় বেগুনি। ফল শিমের মতো, ৪ থেকে ৬ সেন্টিমিটার লম্বা, আংশিক বাঁকানো, বীজের সংখ্যা ৫ থেকে ৯টির মতো। একসময় ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশেই দেখা যেত। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত উদ্ভিদ ও প্রাণিজ্ঞানকোষ-এর তথ্যমতে, গাছটির পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সহজে দেখা মেলে। বিশেষত রাঙামাটির কাপ্তাই এলাকার বনাঞ্চলে সংখ্যায় বেশি। Fabaceae পরিবারের এ উদ্ভিদ মূলত আবাসস্থল ধ্বংসের কারণেই এখন সংখ্যায় কমেছে। ইংরেজি নাম ওয়াইল্ড ইনডিগো, পার্পল টেপ্রোসিয়া, ফিশ পয়োজন ইত্যাদি।

আদি আবাস পূর্ব ভারত। সেখান থেকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া, উষ্ণমণ্ডলীয় আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গাছটি আপাতদৃষ্টে আগাছা হলেও এর অর্থনৈতিক ও ভেষজ গুণ অনেক। সাধারণত পতিত জমি, পাহাড়ের গায়ে ও সড়কের ধারে জন্মে। কোনো কোনো দেশে জমিতে সারের বিকল্প হিসেবে চাষ করা হয়। কারণ, এ উদ্ভিদ বায়বীয় নাইট্রোজেন সংরক্ষণ করতে পারে, যা জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।

বন-নীল রক্ত পরিষ্কারক ও কৃমিনাশক। আবার আলসার ও অ্যাজমা চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা হয়। পাতা অন্ত্রীয় টনিক, ক্ষুধাবর্ধক, ফুসফুস ও বক্ষব্যাধির সমস্যায় কার্যকর। পেটের অসুখ ও ডায়রিয়ায় ব্যবহার করা হয়। গেঁটেবাত, পাইলস ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়েও কার্যকর। বীজতেল চুলকানি, অ্যাকজিমা ও চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার্য। তবে এ গাছে সীমিত পরিমাণ বিষাক্ত উপাদান টেপ্রোসিন আছে, যা মাছ ধরতে ব্যবহার করা হয়। এই উপাদান মাছকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। কিন্তু এ বিষাক্ত উপাদান স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভেষজ উপাদান ও কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্ভিদ বাণিজ্যিকভাবেও চাষ করা যেতে পারে।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top