কুয়াকাটা সৈকতে ২ হাজার একর বনাঞ্চল বিলীন

pfjgjg-1.jpg

অন্যচোখে রিপোর্ট: ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। এরপর সৈকত রক্ষায় কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে সৈকতঘেঁষা বনাঞ্চল। বন বিভাগের হিসাবে ১৩ বছরে ভাঙনে দুই হাজার একর বনাঞ্চল সাগরে হারিয়ে গেছে। উজাড় হয়েছে দুই লক্ষাধিক গাছ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবং সমুদ্রের তলদেশে পলি জমায় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পানির স্তর। ফলে সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে উপকূলে। প্রতিবছর বিভিন্ন দুর্যোগে ঢেউয়ের ঝাপটা ও ভাঙনে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। এতে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকতের কোল ঘেঁষে রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। একসময় সৈকতঘেঁষা নারকেলবাগান, তালবাগান ও জাতীয় উদ্যানের ঝাউবাগান পর্যটকদের আকৃষ্ট করত। কিন্তু নারকেলবাগান ও তালবাগান ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ম্যানগ্রোভ বন এখন উজাড় হয়ে যাচ্ছে।

পটুয়াখালী বন বিভাগ জানায়, কুয়াকাটা, গঙ্গামতি ও খাজুরা—এই তিন ক্যাম্পে মোট বনভূমি ৩ হাজার ৩৮৭ একর। ২০০৫ সালে সরকার ১ হাজার ৮৮৭ একর বনভূমি নিয়ে কুয়াকাটায় জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রাকৃতিক বনসংলগ্ন সৈকতঘেঁষা ১০ হাজার হেক্টর (প্রায় আড়াই হাজার একর) ভূমির ওপর ঝাউবাগান গড়ে তোলা হয়।

কুয়াকাটা সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, সৈকতের ভাঙন কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের দিকে এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন পাকা স্থাপনা ভেঙে পড়ছে। উদ্যানের গাছও উপড়ে পড়ে রয়েছে। ভাঙনে সৈকত ছোট হয়ে এসেছে। সাগরের ঢেউ আঘাত হানছে সৈকত লাগোয়া গাছের ওপর। ঝাপটায় গাছের মূল থেকে বালু সরে শিকড় বেরিয়ে পড়ছে। কোনোরকমে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু গাছ। স্যাঁতসেঁতে বালুর সৈকতে বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গাছের মূল।

বন বিভাগের জরিপকারক মো. রেজাউল করিম বলেন, সিডর-পরবর্তী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস ও সাগরের ঢেউয়ের ঝাপটায় এ পর্যন্ত বনের দুই লক্ষাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ভেঙে এবং উপড়ে পড়ে ধ্বংস হয়েছে। ভাঙনে ৩ হাজার ৩৮৭ একর বনভূমির মধ্যে ২ হাজার ৮৭ একর সাগরে হারিয়ে গেছে। দীর্ঘ ১৩ বছরে বনের ক্ষতি ৬১ দশমিক ৬১ শতাংশ।

কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, সৈকতঘেঁষা নারকেলবাগান ও তালবাগানের কারণে কুয়াকাটা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সৈকতে ভাঙন ও সাগরের ঢেউয়ে তালবাগান বিলীন হয়ে গেছে, নারকেলবাগানটিও এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

এদিকে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতের প্রশস্ত ছিল ৮ কিলোমিটার। অব্যাহত ভাঙনের কারণে আট কিলোমিটার প্রশস্ত সৈকত এখন সংকুচিত হয়ে এমন হয়েছে যে জোয়ারের সময় পর্যটকেরা সৈকতের বেলাভূমিতে নামতে পারছেন না।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে পানির স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ঢেউয়ের তাণ্ডব বেড়ে যাচ্ছে। ঢেউয়ের ঝাপটায় বালু সরে শিকড় বেরিয়ে গাছ মরে যাচ্ছে। বনভূমি রক্ষায় সৈকতের ভাঙন প্রতিরোধের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি নতুন করে বনায়ন করতে হবে। বনে জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ, লবণসহিষ্ণু গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

সৈকতের ভাঙন প্রতিরোধ করে বনভূমি রক্ষার জন্য সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন। তিনি বলেন, ‘গাছ নির্মল বায়ু দান করে, মানুষকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে গাছ মানুষকে রক্ষা করে। কাজেই গাছ ও বন রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’

উপকূলীয় বন বিভাগ পটুয়াখালীর বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন  জানান, অবিরাম ভাঙন এখন সৈকতের দিকে এগিয়ে আসছে। বন বিভাগের পক্ষে সৈকতের ভাঙন রোধ করা প্রায় অসম্ভব। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে সৈকতের ভাঙন প্রতিরোধ করা না গেলে বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পটুয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহীন  বলেন, আপাতত সৈকতের জিরো পয়েন্ট এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী ভাঙনকবলিত অংশে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে জরুরি মেরামতকাজ করা হচ্ছে। সৈকতের স্থায়ী সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের সৈকতের আদলে গড়ে উঠবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top