এখন গ্রাম-শহর কোথাও আর কোনো শকুন নেই

prothomalo-bangla_2021-09_73fc0f12-0975-4d27-b0fd-db7c4afaaebc_C_2-1.jpg

অন্যচোখে রিপোর্ট: আশির দশক বা তার আগে যাঁরা গ্রামে বড় হয়েছেন, তাঁদের নিশ্চয় গরুর ভাগাড়ের কথা মনে আছে। তখন প্রতিটি গ্রামেই ভাগাড় ছিল। পশু মারা গেলে ফেলা হতো এসব ভাগাড়ে। আর এই ভাগাড়ে প্রধান যে পাখিটিকে দেখা যেত, তার নাম শকুন। মরা প্রাণী খেয়ে নিমেষেই সব পরিষ্কার করে ফেলত।

শকুন নিয়ে বহু অশুভ মিথের কথা শোনা যায়। কিন্তু ছোটবেলার সেই শকুন পাখিটিকে নিয়ে মানুষের নানা স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়। সারা দিন শকুনের আশপাশে ঘুরঘুর করা। সুযোগ পেলেই শকুনের গায়ে ঢিল ছোড়া। এত কিছুর পরও ওই ভাগাড় ছেড়ে কিন্তু শকুনগুলো কখনোই পালিয়ে যায়নি। গাঁয়ের মানুষেরাও জানত এ শকুনগুলো চলে গেলে মরা পশুর গন্ধে টেকা অসম্ভব। আর রোগজীবাণুর বিস্তারও তো আছেই!

এখন গ্রাম-শহর কোথাও আর কোনো শকুন নেই। সে সময়ের মানুষগুলোর স্মৃতি থেকেও প্রায় মুছে গেছে শকুনের নাম। গত বছর একজন তরুণ পরিচালক মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি টেলিফিল্ম নির্মাণের জন্য আমাকে ফোন দিলেন। সেখানে একটি দৃশ্য থাকবে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি করে মারবে আর শকুন তাকিয়ে থাকবে ওই লাশের দিকে। আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, দৃশ্যটি এ প্রজন্মের মানুষের কাছে একটি ভুল বার্তা দেবে আর পাখিটির জন্য খুবই নেতিবাচক হবে। এ দেশের সাহিত্য–সিনেমায় সব সময়ই শকুন অবহেলিত। সবারই একটু ভেবে রাখা দরকার, স্বাধীনতার সময় শকুন পাখিটি না থাকলে রোগের বিস্তার ঘটত আরও অনেক বেশি।

শকুনের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রায় অজানা। জানবে কী করে? এ দেশের প্রায় ৫০ হাজার শকুন থেকে মাত্র ২৫০টি শকুন কোনোরকমে টিকে আছে। দেখা যায় মূলত সিলেটের রেমা কালেঙ্গা আর সুন্দরবনে। আর পৃথিবীর প্রায় ৪০ মিলিয়ন শকুন এখন মাত্র ১১ হাজারে ঠেকেছে। শকুনের এ অনুপস্থিতিতে এশিয়াজুড়ে বেড়ে গেছে জলাতঙ্কসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। ভারতে এর বিস্তার বেড়েছে প্রায় ৩০ ভাগ। এসব রোগে প্রতিবছর সাত হাজারের বেশি মানুষ মারা পড়ছে। এ দেশেও এই সংখ্যাটা কম নয়।

শকুন কেন মারা পড়ছে? এ–বিষয়ক গবেষণার ফল আমরা পেয়েছি ২০০৪ সালে। এর আগেই প্রকৃতি থেকে ৯৯ ভাগ শকুন হারিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পশুচিকিৎসক লিডসে প্রথম আবিষ্কার করেন পশুচিকিৎসায় ব্যবহৃত ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক–জাতীয় ওষুধের কারণেই সব শকুন মরে গেছে। এ ওষুধ পশুতে ব্যবহার করার ফলে সেই গরু মারা পড়লে আর শকুন যদি সেই মরা গরু খায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে শকুন মরে যায়।

শকুন রক্ষায় বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান ও গবেষকেরা একটি পথ খুঁজতে থাকেন। জার্মান বিজ্ঞানী জারগের ও তাঁর ওষুধ কোম্পানি মেলোক্সিক্যাম নামের একটি ওষুধ আবিষ্কার করেন। এই ওষুধ পশুচিকিৎসায় দারুণ কার্যকরী এবং শকুনের কোনো ক্ষতি হয় না। এরপর শকুন রক্ষায় ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালে নিষিদ্ধ হয় ডাইক্লোফেনাক। এ–জাতীয় ওষুধটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর কিটোপ্রোফেন, এসিক্লোফেনাক, ফ্লুনিক্সিনসহ বেশ কয়েকটি ওষুধ বাজারে আসে, যা শকুনের জন্য সমান ক্ষতিকর। বাংলাদেশ সরকার এ বছরের জানুয়ারিতে কিটোপ্রোফেনও নিষিদ্ধ করে, যা শকুন রক্ষায় এক যুগান্তকারী উদ্যোগ।

বাংলা শকুন টিকে থাকার লড়াই করছে। সামান্য কটি শকুন রক্ষায় বন অধিদপ্তর ও আইইউসিএন বাংলাদেশ উদ্যোগ নিয়েছে। শকুনের নিরাপদ খাবারের জন্য তৈরি হয়েছে ফিডিং স্টেশন। নিয়মিত নিরাপদ গরু সরবরাহ করা হয় এখানে। এ ছাড়া আহত শকুনের পরিচর্যার জন্য নির্মিত হয়েছে রেসকিউ সেন্টার। ওষুধ কোম্পানিগুলো নিরাপদ ওষুধ মেলোক্সিক্যাম ও টলফামেনিক অ্যাসিডের উৎপাদন বাড়িয়েছে। শকুন রক্ষায় সরকার দুটি নিরাপদ এলাকাও ঘোষণা করেছে।

শকুন রক্ষার দায়িত্ব কিন্তু সরকার বা কোনো সংস্থার একার নয়। বাংলার নামে যে পাখিটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ হয়েছে, তাকে রক্ষায় সবার এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো শকুন রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখলেই বাংলার আকাশে আবার শকুনের নিয়মিত আগমন ঘটতে পারে।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top