অন্যচোখে রিপোর্ট: টাঙ্গাইলের মধুপুরের রত্নখচিত বনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অজস্র মধুবৃক্ষ। এই বৃক্ষগুলো আমাদের মনেপ্রাণে সত্যিকার অর্থে মধুর আবেশ ছড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন সময়ে সেখানকার বন–প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি। টেলকি, আউশনারা, দোখলা—কত অরণ্যপথ পাড়ি দিয়েছি! সখ্য হয়েছে অনেক অচেনা, অজানা দুর্লভ উদ্ভিদের সঙ্গে।
সম্প্রতি আবার দোখলায় যাওয়া হলো দুটি বিশেষ উদ্ভিদের সন্ধানে। সঙ্গী হলেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী হর্টিকালচার সেন্টারের তরুণ উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. মাজেদুল ইসলাম। ফিরতি পথে তাঁর আমন্ত্রণে মাতৃবাগানটি দেখতে গেলাম। ঢোকার পথেই সুসজ্জিত উদ্ভিদের সারি এবং উপস্থাপনার কৌশল নজর কাড়ল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে মনে হলো, বেশ যথেষ্টই আছে মাতৃগাছ এবং তাদের উদ্ভিদশিশুরা। অফিস প্রাঙ্গণের চটকদার মৌসুমি ফুলের নান্দনিক বিন্যাস মনে করিয়ে দিল প্রতিষ্ঠানটি শুধু বাণ্যিজ্যিকই নয়, প্রকৃতিবান্ধবও।
মাজেদুল ইসলাম দেখালেন, একটি ছোট গাছে আমের চারটি রকমফের। তারপর খানিকটা এগিয়েই পাওয়া গেল জাবাটিকাবার গাছটি। কাণ্ড ও ডালপালায় অজস্র ফল ঝুলছে। কালচে রঙের পরিপক্ব ফল খেয়ে দেখা গেল, স্বাদ ভালো। ফলটি বর্ণ, গড়ন ও স্বাদের দিক থেকে অনেকটা লুকলুকি বা পায়লাগোটার মতো। এই ফল গাছ দেশে খুব একটা নেই। আমার দেখা তৃতীয়তম গাছ এটি। বেশ কয়েক বছর আগে ২০১২ সালের দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টার ও পরে গাজীপুরের শ্রীপুরে উদ্ভিদপ্রেমী সাদাত সেলিমের বাড়িতে দেখেছি। এই মাতৃবাগানের গাছটি লাগানো হয়েছিল ২০১৩ সালের দিকে।
জাবাটিকাবা বা জাবুটিকাবা (Plinia cauliflora) ব্রাজিলের মিনাস জারিয়াস, গোইস এবং সাও পাওলো রাজ্যের স্থানীয় উদ্ভিদ। চিরসবুজ এই গাছ ধীরে বাড়ে, সাধারণত ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কচি পাতার রং ঈষৎ গোলাপি। দক্ষিণ আমেরিকার এই গাছ এরই মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন উষ্ণাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। চাষের জন্য আর্দ্রতাসমৃদ্ধ হালকা অম্লীয় মাটি পছন্দ। তবে বালিবেষ্টিত ক্ষারীয় সমুদ্রসৈকত ও উপকূলীয় অঞ্চলে বেশ ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। গাছ কিছুটা খরাসহিষ্ণু। অতিরিক্ত খরায় ফলের উৎপাদন কমে যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সেচ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা ঠিক রাখতে পারে। এ গাছের কাণ্ড ও ডালপালাভতি৴ সাদা রঙের অজস্র ফুল বেশ নান্দনিক। জন্মস্থানে বছরে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়বার ফুল ও ফল হতে দেখা যায়। আমাদের দেশে বছরে সাধারণত একবারই বসন্তকালে ভালো ফলন হয়।
৩ থেকে ৪ সেমি ব্যাসের এই ফলগুলোর আবরণ কিছুটা পুরু। গায়ের রং অনেকটা কালোজামের মতো। পরিপক্ব ফলের ভেতরের খাদ্যাংশ সুমিষ্ট। তাতে চারটি বীজ থাকে, অবশ্য প্রজাতিভেদে বীজের সংখ্যা ও আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। পাকা ফল স্বাভাবিকভাবেই খাওয়া যায়। এ ফলে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নানা ধরনের প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে। প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন সি ছাড়াও রয়েছে ফসফরাস, ফলিক অ্যাসিড, পটাশিয়াম, ভিটামিন ই এবং বিভিন্ন প্রকারের বি ভিটামিন। এ ছাড়া ফল থেকে জেলি, আচার বা জুস তৈরি করে খাওয়া যায়। ব্রাজিলে প্রাক্-কলম্বিয়ান সময় থেকে জাবাটিকাবার চাষ হচ্ছে। বর্তমানে এটি সে দেশের মূল কেন্দ্র এবং দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল। কলমের গাছগুলোয় পাঁচ বছরে ফলন পাওয়া যেতে পারে। বীজের গাছগুলোয় ১০ থেকে ২০ বছর সময় লাগতে পারে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন গাছটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপন্ন গাছ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।