গৌরাঙ্গ নন্দী : মধ্য সেপ্টেম্বরের একটানা বৃষ্টিতে ভবদহ এলাকা আবারও জলাবদ্ধ কবলিত হয়েছে। আবারও লাখো মানুষের নাকের জল, চোখের জল একাকার হচ্ছে। সেই পরিচিত দৃশ্য, মানুষের আঙ্গিনা, ঘর-স্কুল-কলেজের মধ্যে পানি; এক ঘর হতে আর এক ঘরে যেতে সাঁকোর প্রয়োজন হচ্ছে। এবারের বৃষ্টিতে শুধুমাত্র ভবদহ এলাকা নয়; যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরার অনেক এলাকা কম-বেশী জলাবদ্ধ কবলিত হয়ে পড়েছে। তবে ভবদহ এলাকা এবং বিল ডাকাতিয়া এলাকার অবস্থা খুবই খারাপ। জলাবদ্ধ এলাকা হিসেবে এক সময়ে বিল ডাকাতিয়ার নাম ছড়িয়েছিল। আর ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতাও সেই ১৯৮৬ সাল হতে। জলাবদ্ধতা নিরসনেও নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি, জলাবদ্ধতার নিরসন হয়নি। শেষ কয়েক বছরে অনেকগুলো পাম্প বসিয়ে বদ্ধ পানি সেঁচে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ভূক্তভোগী এলাকাবাসী এর বিরোধিতা করলেও সুবিধাভোগীরা এর মাহাত্ম বর্ণনা করেছে। যে বছর মৌসুমী বৃষ্টির দাপট বেশী হয়, সে-বছর বিপত্তি বাড়ে। এবারও যার ব্যতিক্রম হয়নি।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ভবদহ এলাকাটি মাঝে-মধ্যে তীব্র জলাবদ্ধতা কবলিত হয়। মানুষের জীবন-জীবিকা বাধাগ্রস্ত হয়। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলায় মানুষের হতাশা বাড়ে। জলাবদ্ধতা নিরসনে কর্তৃপক্ষ তথা পানি উন্নয়ন বোর্ড -পাউবো একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু জলাবদ্ধতা হতে মানুষ মুক্তি পায়নি। প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় জলাবদ্ধতা নিরসনে খুলনা-যশোর রোডের আমডাঙ্গায় খাল কেটে ভৈরব নদীর সঙ্গে বিলের সংযোগ করে দেয়া হয়েছিল। জলাবদ্ধতা সাময়িক দূরীভূত হয়েছিল, কিন্তু ওই খালও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করায় পরে আর কাজ করেনি। ভূক্তভোগীরা জলাবদ্ধতা নিরসনে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বা জোয়ারের নদী ব্যবস্থাপনার কথা দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নের কথা বললেও স্বার্থান্বেষী একটি চক্র কাপালিয়া বিলে টিআরএম বাস্তবায়নে বাধা দেয়, প্রকৌশলীদের মারধর করে। ফলে তা বন্ধ হয়ে যায়। আবার পরে, একটি গোষ্ঠী প্রচার করে, এটি প্লাবন-ভূমি নয়; এটি জলাভূমি। প্লাবন-ভূমি মানে যেখানে নদীর জোয়ারের পানি ওঠে; নদীর সাথে সংযোগ নীচু-ভূমি। আর জলাভূমি নদীর সাথে সংযোগবিহীন, প্রাকৃতিক জলাশয়।
প্রকৃতপক্ষে, জলাবদ্ধতা সমস্যাটি নদী ব্যবস্থাপনা ভাবনার গলদের মধ্যে নিহিত। নদীকে নিয়ন্ত্রণ করে কৃষি উন্নয়নের জন্য আমরা যে ব্যবস্থাপনাটি ১৯৬০এর দশকে শুরু করি, তা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উপকারের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশী। ওই সময়ে পাউবো গৃহীত কোস্টাল ইমব্যাঙ্কমেন্ট প্রজেক্ট (সিইপি)-এর আওতায় পোল্ডার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এরই অংশ হিসেবে যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত বিশাল প্রস্থের টেকা-হরি-শ্রী নদীর দু’পাশে মাটির বাঁধ দিয়ে ছোট করা হয়। সেখানে তৈরি করা হয় ২১ ভেন্টের (কপাট) স্লুইস গেইট। টেকা ও শ্রী-নদীর সংযোগ স্থলে পানির তীব্র গতিপ্রবাহে চক্রাকার ঘূর্ণন স্রোত তৈরি করতো, স্থানীয় ভাষায় তা ঘোল বা দহ বলা হতো। এই ঘোলে পড়লে নৌকাডুবি হতো, নৌকাযাত্রীদের প্রাণহানি অর্থাৎ ভবলীলা সাঙ্গ হতো। তাই এলাকাটির নাম হয়েছিল ভবের দহ তথা ভবদহ। যশোর ও খুলনা জেলার তিন উপজেলার সংযোগস্থলে এই ভবদহ-র অবস্থান। এখানেই ২১ কপাটের স্লুইস গেইট, পাশেই আছে ৬ কপাটের আর একটি স্লুইস গেইট। উদ্দেশ্য ছিল হরি নদীর পশ্চিম পাশ, টেকা-মুক্তেশ্বরী, আপার ভদ্রা, হরিহর এবং বুড়ীভদ্রা অববাহিকার প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর (এক হেক্টর=২.৪৮ একর) এলাকার পানি নিষ্কাষণ করা। এই পুরো এলাকাটি এ্খন ভবদহ নামে পরিচিত। এখানে যশোর জেলার অভয়নগর, যশোর সদর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার চল্লিশটি ইউনিয়নের ৪৪৪টি গ্রামের দশ লাখের বেশী এবং খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ছয় ইউনিয়নের ৪১টি গ্রামের প্রায় এক লাখ সর্বমোট ১১ লাখেরও বেশী মানুষ বসবাস করেন।
এই বিশাল এলাকার পানি নিষ্কাষণের জন্য যে নদী ব্যবস্থাপনাটি ছিল, তা ভেঙ্গে-দুমড়ে আমরা বাঁধ, স্লইস গেইটভিত্তিক নতুন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলি। আগে টেকা-মুক্তেশ্বরী, হরি, আপারভদ্রা, বুড়ী ভদ্রা ও হরিহর -এই ৫টি নদী দিয়ে সমগ্র এলাকার পানি নিষ্কাশিত হতো। নতুন ব্যবস্থাপনায় টেকা-মুক্তেশ্বরীর পানি ভবদহ স্লুইস গেটের ভিতর দিয়ে হরি নদীর মাধ্যমে ভাটিতে কাসিমপুর ত্রিমোহনায় পৌঁছায়। অন্যদিকে, আপারভদ্রা, বুড়ীভদ্রা ও হরিহর নদীর পানি হড়হড়িয়া ত্রিমোহনায় যুক্ত হয়। এখানে হরিহর ও বুড়ীভদ্রার পানিও এসে পড়ে। এই দুটি ¯ স্রোতের মিলিত ধারা আপারভদ্রা নাম নিয়ে কাসিমপুর ত্রিমোহনায় মেশে। এখান থেকে এই পাঁচটি নদীর মিলিত ধারা তেলিগাতী নদী নামে খর্ণিয়া ব্রীজের নীচ দিয়ে ঘ্যাংরাইল নদীর সাথে যুক্ত হয়ে বারোআড়িয়া মোহনায় শিবসা নাম ধারণ করে সাগরে পৌঁছেছে। সাগর থেকে উঠে আসা পলিমিশ্রিত জোয়ারের পানিও একইভাবে ওই নদীপথেই উত্তরের বিলগুলিতে ছড়িয়ে পড়তো। বিলে পলি জমে ভূমি উঁচু হতো।
সিইপি’র আওতায় গড়ে তোলা পোল্ডার ব্যবস্থায় জোয়ারে আসা পলি নদীর বুকে জমতে থাকে। এতে একদিকে, নদীর বুক উঁচু হওয়া এবং বিপরীতে, বিল-ভূমি নীচু থাকায়, বিলের মধ্যে পানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। যার সূচনা সেই ১৮৮৬ সালের দিকে। প্রায় চার দশক ধরে চলমান এই জলাবদ্ধতায় জন-জীবন একেবারে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। এবারের প্রবল বর্ষায় আবারও সেই জলাবদ্ধতায় নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে মানুষকে। #