নিজস্ব প্রতিবেদক: উপকূলীয় খুলনা অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ এখনো সুপেয় পান করতে পারেন না। নিয়মিত লবণ পানি পান করার জন্য তারা প্রতিনিয়ত নানান রকমের অসংক্রমক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই ওই এলাকায় পানি সমস্যা ও সংকটের সমাধানের জন্য স্বতন্ত্র নীতিমালা তৈরি দাবি জানানো হয়েছে।
শনিবার দুপুরে খুলনায় এক কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা এই দাবি তোলেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (প্রান) ‘পানি অধিকার প্রচার’ অভিয়ানের অংশ হিসেবে এই কর্মশালার আয়োজন করে।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা উপকূলীয় এলাকায় পানির সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন দাবি ধরেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা জেলা সমন্বয়কারী আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম বলেন, সুপেয় পানি ব্যবস্থাপনার বর্তমানে যেসব আইন ও নীতিমালা রয়েছে, তা অত্যন্ত বিতর্কিত এবং কালো আইনের মতো আইন। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার সাথে উপকূলীয় এলাকার বেশ তফাত রয়েছে। একই নীতিমালা বা আইন দিয়ে সব এলাকার পানি ব্যবস্থাপনা করা যায় না। দেশের উত্তরাঞ্চলে ভৌগোলিক অবস্থানে আর দক্ষিণাঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান একই রকম নয়। তাই উপকূলীয় দক্ষিণ অঞ্চলের জন্য আলাদা করে সুপেয় পানির ব্যবস্থাপনার আইন করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমানের মুকুল বলেন, এই এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মাঝে বাড়িতে পানি ধরে কার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ট্যাংকি বিতরণ করতে হবে।
সেন্টার ফর এনভারমেন্ট এন্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চের (সিইপিআর) চেয়ারম্যান গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা, জীবনের মান উন্নত করা, খাদ্য তৈরি, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ এবং বাস্তু সংস্থান সকল ক্ষেত্রেই পানি অপরিহার্য। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালের জাতীয় পানি নীতি এবং ২০১৩ সালের জাতীয় পানি আইনের মাধ্যমে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের উপর জোর দিয়েছে। ২০১০ সালে, জাতিসংঘ বিশুদ্ধ পানির অধিকারকে মানবাধিকার বলে ঘোষণা করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ১৯টি জেলা রয়েছে যেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই দুর্যোগগুলো পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, মানুষের স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদকে ক্ষতিগ্রস্থ করে দেশের উন্নয়ন ও মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে হুমকিতে ফেলে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। ঋতুভেদে সংকটের ধরণে বৈচিত্ত্র্য থাকলেও এই সংকট বছরজুড়ে চলমান। সমুদ্র তীরবর্তী অবস্থান, প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্যতা হ্রাস, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মাটি ও পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত এবং অপরিকল্পিত ব্যবহার, সার্বিকভাবে জলবায়ু সৃষ্ট সংকট এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণে সুপেয় পানির ঘাটতি উপকূলীয় মানুষের জীবনযাপনের ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রানের সমন্বয়কারী উম্মে সালমা ও কর্মসূচি কর্মকর্তা জাহিদ হাসান। তারা জানান, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং বাংলাদেশের অবস্থানের কারণে প্রতি বছর গড়ে ৩.২ মিলিমিটার হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। কিছু বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.৭৫ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের এই বৃদ্ধি দেশের ভিতরে আরও নোনা পানি নিয়ে আসবে, যা মানুষদের পান ও চাষের জন্য নির্ভর করা স্বাদু পানির উৎসগুলোকে নষ্ট করে দিবে। ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশে লবণাক্ত পানি দ্বারা প্রভাবিত এলাকা ২৭% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি অব্যাহত রয়েছে। উচ্চ লবণের মাত্রা ইতিমধ্যে এক মিলিয়ন হেক্টর জমিতে প্রভাব ফেলছে, যা ফসলের উৎপাদন ব্যপক ভাবে হ্রাস কমিয়ে দিয়েছে।
প্রবন্ধ উপস্থাপনে আরও জানানো হয়, লবণের মাত্রা বৃদ্ধি শুধু ফসলই নয়, মানুষের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে। পানিতে বেশি লবণ উচ্চ রক্তচাপের বাড়ায়, বিশেষ করে গর্ভবর্তী মহিলাদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি যেমন, লিভারের সমস্যা এবং শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির সমস্যা সৃষ্টি করে। সুপেয় পানির সংকট ও পানি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলকে দক্ষিন-পশ্চিম, মধ্যম, মধ্য-দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল এর মতো চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ভৌগলিক ভাবে ভিন্ন এই অঞ্চলগুলোর প্রতিটিতেই পানি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে।